১৫৯তম জন্মবার্ষিকীতে স্মরণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছেলেবেলা স্কুলের কথা বলে যিনি চার দেয়ালের গণ্ডির ভেতর থাকতে চাইতেন না। স্কুলে ভর্তি করার পর তিনি আচমকা কাঁদতে লাগলেন যে প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিতে তার মন বসে না। দেশের হাজারো নামকরা পণ্ডিত, বিদ্বান সবাইকে আনা হলো বিদ্যাশিক্ষার জন্য, কিন্তু একে একে সকলে ব্যর্থ। সতেরো বছর বয়সে বিলেতে পাঠানো হলো ব্যারিস্টারি সম্পন্ন করার জন্য, কিন্তু তাও ফিরতে হলো খালি হাতে। বড় দিদি সৌদামিনী দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ছেলেটার মানুষ হওয়ার আর কোন আশা রহিল না।”

এতক্ষণে হয়তো কারও বুঝতে বাকি নেই কার কথা বলছিলাম, তিনি আর কেউই নন আমাদের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা। বাংলা সাহিত্য তো বটেই, গোটা পৃথিবীর সাহিত্য অঙ্গনকে যিনি করেছিলেন আলোকিত। পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তের সেরা দার্শনিক হিসেবে যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী কবি পাবালো নেরুদার মতো মানুষও যার কবিতা নকল করে ধন্য হয়েছিলেন।

সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচরণ নেই। নিজে কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন না, অথচ বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই গান গেয়ে মাতিয়েছেন পুরো বিশ্ব। শুধু গান কেন; ছোট গল্প, উপন্যাস, কাব্য, নাটক-সব ধরণের রচনাতেই তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এমনকি জীবনের শেষ বয়সে তিনি এসে আঁকা শুরু করলেন ছবি, তাও পৃথিবীব্যাপী সমাদৃত হলো। গীতাঞ্জলী কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেও তার রচিত অনেক কাব্যগ্রন্থ আছে (যেমন: বলাকা, চিত্রা, সোনার তরী, মানসী ইত্যাদি) যেগুলোর প্রত্যেকটির জন্য পৃথক পৃথকভাবে তাকে নোবেল প্রাইজে ভূষিত করার দাবি রাখে। আবার ছোট-গল্পেও তার জুড়ি মেলা ভার।

বলা হয়ে থাকে যে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি যদি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত নাও হতেন; তবে ছোটগল্পের জন্য অবশ্যই তিনি নোবেল প্রাইজ লাভ করতেন। উপন্যাস কিংবা নাটক রচনাতেও তিনি অসামান্য পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। “শেষের কবিতা” উপন্যাসটি আনুমানিক ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচনা করা। সেই সময় তিনি এ উপন্যাসে যেভাবে তথাকথিত আধুনিকতা আর আটপৌরে জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, তা আজকের যুগেও আমাদের অনেকের চিন্তার পরিধির বাহিরে।

“চোখের বালি”, “গোরা”, “নৌকাডুবি”, “যোগাযোগ”, “বৌ ঠাকুরানীর হাট”, “ঘরে বাইরে” প্রত্যেকটি উপন্যাসই অসামান্য। সব জায়গায় তিনি গেয়েছেন মানবিকতার জয়গান। নোবেল পুরস্কার লাভ যেন তার কৃতির যৎসামান্য কৃতিত্ব বৈ আর কিছুই নয়।

দুঃখ আর বিরহের সময় মনকে সান্ত্বনা দিতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কোন বিকল্প নাই। পৃথিবীতে যে কোন কিছু পুরাতন হতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্র সঙ্গীত কখনও পুরান হতে পারে না। এর সুর, লয়, ছন্দ এগুলো সত্যিকার অর্থেই প্রশংসা না করলেই নয়। আর, গানের শব্দ ভাণ্ডার সে তো সত্যি অনবদ্য। এত সুন্দর করে সুর, তাল, ছন্দ, লয়ের সমন্বয় করে এবং এত সুনিপুণভাবে শব্দ চয়ন করে বোধ হয় খুব কম মানুষই গান রচনা করতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আলাদা। আজকে পৃথিবীর অনেক দেশেই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে ব্যবহার করা হচ্ছে সাইকোথেরাপির কাজে। রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলেই যে কারও মনে এক অনাবিল প্রশান্তির সৃষ্টি হতে বাধ্য।

আমাদের বাঙালিদের গর্ব যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছেন, যে ভাষায় সঙ্গীত রচনা করেছেন। তা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের এ ভারতীয় উপমহাদেশে আর কোন ভাষায় এরকম কবি বা সাহিত্যিক পাওয়া যাবে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসঙ্গে বিশ্বের তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের পাশাপাশি সিংহলের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতাও তিনি। শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব আনন্দ সামারাকুন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ও সংগীত বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছাত্র আনন্দ সামারাকুনের জন্য বাংলা ভাষায় নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা গানটি রচনা করেন এবং এর সুর দেন।

সামারাকুন তারপর ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীন শ্রীলঙ্কায় ফিরে যান এবং সিংহলি ভাষায় গানটি অনুবাদ করেন। যার প্রথম লাইন হচ্ছে নমো নমো মাতা আপা শ্রীলঙ্কা নমো নমো মাতা, সুন্দর শ্রী বরণী। তার অনুবাদের পর শ্রীলঙ্কার মিউসেস কলেজ নামক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গায়ক দল গানটি প্রথম পরিবেশন করেন। তারপর গানটি সমস্ত দেশ জুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তৎকালীন সময়ে বেতারে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গানটি।

১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা গ্রেট ব্রিটেন হতে স্বাধীনতা অর্জন করে। ২২ নভেম্বর ১৯৫১ সালে সে সময়ের শ্রীলঙ্কার সরকার কিছু পরিবর্তন সাধিত করে অবশেষে গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রূপে ঘোষণা করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এ বাংলা সাহিত্যকে একাই শতকরা পঞ্চাশ ভাগের মতো পূর্ণতা দান করে গেছেন। তিনি এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল পুরস্কার অর্জন করার কৃতিত্ব গড়েছেন। এটা আমাদের জাতিসত্তার মানুষদের জন্য এক বিরাট গৌরব। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আর কেউই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করার মতো কৃতিত্বের অধিকারী হতে পারেননি এখনও। অত্যন্ত আটপৌরে ছিল তার জীবন। নিজের কীর্তিকে তিনি কখনও বিশ্বাস করেননি। বরং বলেছেন যে- “কালের তরঙ্গে এসব ধুয়ে-মুছে যাবে।” মানুষের প্রতি তিনি কখনও বিশ্বাস হারাননি। তিনি সব সময় বলতেন যে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানও সবচেয়ে বড় পাপ।

লিখার হাত যেমন ছিল সিদ্ধহস্ত খাবারেও ছিলেন খুবই ভোজনরসিক। জলখাবারের তালিকাটি বেশ বড়ই ছিল তার। মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা ভেজানো। গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে ডিম সিদ্ধ। সঙ্গত দেয় অস্ট্রেলিয়া থেকে আনানো মধু দিয়ে মাখানো পাউরুটি, ফল। সব শেষে এক খাবলা মুড়ি আর চিনি দেওয়া কফি! কাঁচা আম খেতেও ভালবাসতেন। আচারও খেতেন। লিখতে লিখতে খেতেন আমসত্ত্ব, দুধ আর সন্দেশ। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। তারপর সারাজীবন ধরে বহু দেশ ঘুরেছেন। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরণের খাবার খেয়েছেন। যেগুলো ভাল লেগেছে সেগুলো চালু করেছেন নিজ বাড়িতে।

ইউরোপের কন্টিনেন্টাল ডিশের একটি ফ্রুট সালাদ তিনিই চালু করেছিলেন বাড়িতে। বাড়িতে সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসতেন। জাপানি চা পছন্দ করতেন কেবল তা-ই নয়, সঙ্গে তাদের চা খাওয়ার রেওয়াজটিও ছিল তার পছন্দের। তাই তিনি জাপানে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তার জন্য ‘টি সেরিমনি’ এর আয়োজন করতেন গুণমুগ্ধরা। দেশি খাবারের মধ্যে পছন্দ করতেন কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা দিয়ে মুগের ডাল এবং নারকেল চিংড়ি। এছাড়া তিনি কাবাব খেতে খুব পছন্দ করতেন। এর মধ্যে ছিল শ্রুতি মিঠা কাবাব, হিন্দুস্তানি তুর্কি কাবাব, চিকেন কাবাব নোসি।

তার স্ত্রীর রান্না বাড়ির অন্দরমহলে খুব জনপ্রিয় ছিল। তিনি নাকি টকের সঙ্গে ঝাল মিশিয়ে বেশ নতুন নতুন পদ তৈরি করতেন। তিনিও খুব পছন্দ করতেন স্ত্রীর হাতের রান্না। এমনকি অনেকসময় গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে স্ত্রীকে বলতেন খাবার বানিয়ে আনতে। বাড়িতে রান্নায় মিষ্টি দেওয়ার প্রচলন ছিল। নিয়মিত অবশ্যই থাকত সুক্ত আর দইমাছ। শেষপাতে তার আবার পান চাই। নাতজামাই কৃষ্ণ কৃপালিনী তাকে একটি সুদৃশ্য পানদানি বা ডাবর উপহার দিয়েছিলেন, যা আজও রক্ষিত আছে। যেমন রক্ষিত আছে তার স্ত্রীর রান্নাঘর। সেখানে রয়েছে তার ব্যবহৃত একটি চুলা, আর বেশ কিছু চিনামাটির বাসন। অতিথি আপ্যায়ন যেন ছিল তা র কাছে নেশার মতো। বলা হয়ে থাকে ঠাকুর বাড়িতে যারা প্রবেশ করেছেন কেউ কোন দিন খালি মুখে ফেরত যাননি।

উত্তরাধিকারসূত্রে তো বিশাল জমিদারি দেখাশুনা করার দায়িত্ব তার কাঁধে থাকলেও কখনও কোন ধরণের বিলাসিতা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং নিজের জমিদারির অর্থ দিয়ে কৃষকদের জন্য গড়ে তোলেন কৃষি ব্যাংক যা উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম কৃষি ব্যাংকিং নামে সমধিক স্বীকৃত। আজকে আমরা যে “মিল্ক ভিটা” ডায়েরি প্রোডাক্টের কথা জানি সেটিও তার কীর্তি। নিপীড়িত মানুষদের প্রতি তার কণ্ঠস্বর ছিল সদা বলিষ্ঠ। “দুই বিঘা জমি”- নামক বিখ্যাত কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন এভাবে-

“এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি;

রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি! ”

আজকে তার রচিত কোন কবিতার দুইটি চরণ কিংবা কোন গদ্যাংশের দুটি লাইন নিয়েও সৃষ্টি হয়ে গেছে অনেক প্রবাদ-প্রবচন। অনেক সময় সৃষ্টি হচ্ছে নাটক। অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্রিটিশ সরকার যখন তাকে “নাইট”-উপাধিতে ভূষিত করেন; তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়াওয়ালবাগে নিষ্ঠুর ইংরেজ শাসকদের গুলিতে প্রাণ হারানো জাতীয় বীরদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই তার এ প্রতিবাদ।

বিশ্বে যদি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচ জন সাহিত্যিকের তালিকা করা হয় তবে আমার মতে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রাখতেই হবে। ইংরেজি সাহিত্যে যে রকম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, রুশ সাহিত্যে যেরকম লিও তলস্তয়, জার্মান সাহিত্যে গ্যায়টে, ফ্রেঞ্চ সাহিত্যে ভিক্টর হিউগো, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে গর্সিয়া মার্কুয়েজ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ঠিক একই রকমভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো ২০০৪ সালে বিবিসির করা এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে সেরা তিনে স্থান পেয়েছেন।

গতকাল ৭ মে, বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ২৫ বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৬১ সাল এবং বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে তিনি কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা মহর্ষি দেবনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সবাই ছিলেন ভিন্ন এক উচ্চতার মানুষ। জন্মবার্ষিকীর এ দিনে তাই তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।