মৃণাল সেন: নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের সংগ্রাম ফুটিয়ে তোলা কালজয়ী ৮ সিনেমা

বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে বিশ্বব্যাপী কিংবদন্তি হয়ে আছেন পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক মৃণাল সেন। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের পর মৃণাল সেনই এমন একজন পরিচালক যার হাত ধরে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে এক নতুন ধারার প্রবর্তন হয়েছিল। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) তাঁর ৯৭ তম জন্মদিন।

১৯৫৫ সালে ‘রাত ভোর’ ছবির মাধ্যমে পরিচালনা শুরু করেন মৃণাল সেন। তার পরের ছবি ছিল ‘নীল আকাশের নীচে’। ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং ‘ভুবন সোম’ ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান তিনি। ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও ৪টি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন মৃণাল সেন।

মৃণাল সেনের ছবিতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রাম ফুটে উঠত। মানুষের জীবনের নানামুখী সংকটগুলো সিনেমায় দেখাতেন তিনি। সবসময় সিনেমার অর্থ খুঁজে বেড়াতেন মৃণাল সেন।

জেনে নিন মৃণাল সেনের কালজয়ী কিছু সিনেমা সম্পর্কে।

পদাতিক (১৯৭৩): এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা ধৃতিমান চ্যাটার্জি। এটি মৃণাল সেনের কলকাতা ত্রয়ীর তৃতীয় ছবি। ৭০ এর দশকের প্রথমদিকের কলকাতার চিত্র দেখা যায় এই সিনেমাতে। ছবির গল্পে একজন রাজনৈতিক এক্টিভিস্ট ক্রমাগত তার দলের নেতাদের কথায় নীতি বিরুদ্ধ কাজ করতে বাধ্য হয়। পরে সে তার ভুল বুঝতে পারে। ঘটনা প্রবাহে সে একজন ডিভোর্সি মহিলার এপার্টমেন্টে আশ্রয় নেয়। পরে সে দলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

কলকাতা ৭১ (১৯৭২): কলকাতা ৭১ চলচ্চিত্রটি চারটি আলাদা আলাদা গল্পের সমষ্টি। সমরেশ বসু, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ শ্যান্যাল ও মৃণাল সেনের গল্পের উপর ভিত্তি করে ছবিটি নির্মাণ করা হয়। কলকাতা ৭১ চলচ্চিত্রে উৎপল দত্ত মাধবী মুখার্জি অভিনয় করেছিলেন।

ইন্টারভিউ (১৯৭০): মৃণাল সেনের কলকাতা ত্রয়ীর প্রথম ছবি ইন্টারভিউ। চলচ্চিত্রটিতে রঞ্জিত মল্লিক ও করুণা ব্যানার্জি অভিনয় করেছিলেন। ছবির গল্পে রঞ্জিত মল্লিক একজন শিক্ষিত যুবক। একটি ছোট প্রেসে কাজ করে। তার বাড়িতে দিদি ও মা আছেন। তাদের একজন পারিবারিক বন্ধু একটি বিলাতি কোম্পানিতে চাকরি করে। সেখানে রঞ্জিতকেও চাকরি দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। শর্ত দেয়া হয় চাকরির জন্য রঞ্জিতকে বিলাতি কায়দায় কোট প্যান্ট পরে ইন্টারভিউতে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বনায় কোট-প্যান্ট জোগাড় করার পরেও হারিয়ে ফেলায় সেই ইন্টারভিউতে কোট প্যান্ট পরে যেতে পারেনি রঞ্জিত। বাধ্য হয়ে বাঙালি ঐতিহ্যবাহী ধুতি পাঞ্জাবী পরে যায় এবং তার চাকরি হয় না।

একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯): একদিন প্রতিদিন ছবির গল্পে পরিবারের বড় মেয়ে সংসার চালায়। বেকার বড় ভাই সহ পরিবারের বাকি সবাই তার উপর নির্ভরশীল। এক রাতে মেয়েটি বাড়ি ফিরে না। সবাই দুশ্চিন্তা করে ও আতংকিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সেই দুশ্চিন্তা কি ভালবাসার? নাকি একমাত্র উপার্জনের উৎস হারানো? সমাজের কাছে এই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন মৃণাল সেন। এই ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন মৃণাল সেন।

খণ্ডহর (১৯৮৪): ছবির গল্পে দেখানো হয় তিন বন্ধু দীপু, সুভাষ, অনিল হুট করে একদিন দীপুদের গ্রামে বেড়াতে যায়। সেখানে তাদের পরিচয় হয় এক মা ও মেয়ের সাথে। অন্ধ মা মনে করে এই তিন বন্ধুর একজন হলো নিরঞ্জন নামে এক যুবক, যে তার মেয়ে যামিনীকে বিয়ে করার কথা দিলেও আর ফিরে আসেনি। বন্ধুদের মাঝে যে চিত্রগ্রাহক, যামিনীর জন্য তার মায়া লাগে। তাই সে নিরঞ্জন সেজে থাকে যামিনীর মায়ের কাছে। সেখানে তাদের কয়েক সপ্তাহ থাকতে হয় এবং নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন নাসিরুদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমি। ছবির জন্য মৃণাল সেন জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।

আকাশ কুসুম (১৯৬৫): এক মধ্যবিত্ত যুবকের আকাশ কুসুম ছোঁয়ার কাহিনী তৈরি হয়েছে এই ছবি। মধ্যবিত্ত যুবক সৌমিত্র। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সৌমিত্রের বিত্তবান বন্ধু। সৌমিত্রের উচ্চবিত্ত প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেন অপর্ণা সেন। ছবিতে সৌমিত্র নিজের দৈন্যতা অপর্ণার কাছে গোপন রাখতে তার বড়লোক বন্ধুর কাছ থেকে একটি গাড়ি ও দামী বাড়ি ধার নেয়। কিন্তু কোনোদিনই নিজের আসল অবস্থা প্রেমিকার কাছে উন্মুক্ত না করতে পারায় প্রেমে ও জীবনে ব্যর্থ হয় মধ্যবিত্ত সেই যুবক।

মৃগয়া (১৯৭৬): এই ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন এক আদিবাসী শিকারির ভূমিকায়। শিকারি হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের কাছে। কিন্তু ধার শোধ করতে না পারায় এক মহাজন তার স্ত্রীকে অপহরণ করে। সেই মহাজনকে হত্যার দায়ে তার বিচার ও মৃত্যুদণ্ড এবং তাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের জোট বাঁধা নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবির কাহিনী।

ভুবন সোম (১৯৬৯): এই চলচ্চিত্র অভিনেতা উৎপল দত্ত ছিলেন পশ্চিমা কায়দায় জীবন যাপনে অভ্যস্ত এক রেলওয়ে অফিসারের ভূমিকায়। গুজরাটে হাঁস শিকার করতে গিয়ে তিনি আমলাতন্ত্রের বাইরের সরল জীবনের আনন্দ উপলব্ধি করতে পারেন। ছবিতে এক সাঁওতাল মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুহাসিনী মুলে। এই ছবির জন্য সেরা ছবি ও সেরা পরিচালক বিভাগে দুটি জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন মৃণাল সেন।