শূন্যরেখার কাছে মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বেগ

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের কাছে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বর্ডার গার্ড পুলিশকে (মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী) চিঠি দিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩৪ ব্যাটালিয়ান। গতকাল শুক্রবার এই প্রতিবাদ পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এখনো কোনো জবাব দেয়নি।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মিয়ানমারের সীমানায় গোলাগুলির ঘটনায় এক মিয়ানমার সীমান্তরক্ষীসহ তিনজন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী নিহত অন্য দুজন মিয়ানমার রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আরসার সদস্য।

তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে মিয়ানমারের সীমানার ৫০০ থেকে ৬০০ গজের মধ্যে উত্তর রাখাইনের মংডু জেলার মি ডেক গ্রামে এই গোলাগুলির  ঘটনা ঘটে।  এতে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি বাসিন্দা ও তুমব্রু গ্রামের কোনারপাড়া শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশটির অভ্যন্তরে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একটি যৌথ অভিযান পরিচালনা করছিল তারা।

এ ঘটনায় বিজিবি সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। কক্সবাজারে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ আজ শনিবার দুপুরে জানান, সীমানার একেবারে কাছে এই গোলাগুলির ঘটনার উদ্বেগ জানিয়ে শুক্রবার বিকেলে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের কাছে একটি প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছি। তবে এই প্রতিবাদের কোনো জবাব মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী দেয়নি।

বিজিবির অধিনায়ক বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা বলেছে, দেশটির ৫০০ গজ ভেতরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপি যৌথভাবে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালিয়েছিল। সেই অভিযানের সময় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।’

বিজিবির কর্মকর্তা জানান, সীমান্তের এত কাছাকাছি গোলাবর্ষণ বেআইনি। সীমান্ত এলাকায় এ রকম অভিযান চালানোর আগে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে আগে থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর নিয়ম রয়েছে।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদ বলেন, গুলিবর্ষণের শুরুতে শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা ভয়ে ছিল। পরে তারা জানতে পারে ঘটনাটি সে দেশের ভেতরে ঘটছে। এ ঘটনায় সীমান্তে বিজিবি সর্বোচ্চ সর্তকাবস্থানে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানান তিনি।

মিয়ানমার বাহিনীর এভাবে হঠাৎ করে গুলিবর্ষণ শুরু করলে সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দেয়।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমদুম ইউনিয়নের বাসিন্দা ও সাংবাদিক আজিজুল হক জানান, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রায় সময় গুলিবর্ষণ করে থাকে। তবে বৃহস্পতিবার বিকেলে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলি চলে। এতে সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী বিজিবি সতর্ক পাহারায় ছিল বলে তিনি জানান।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মির তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত এক বছর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলছে। বাংলাদেশের তুমব্রু সীমানার কাছাকাছি এলাকায়ও আরাকান আর্মির বেশ কয়েকটি ঘাটি রয়েছে বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়। এই ঘাঁটি লক্ষ করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রায় সময় গুলিবর্ষণ করে থাকে। গত এক দেড় বছরে আরাকান আর্মি দমন অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু ও বুচিডং জেলার বিভিন্ন গ্রামের অনেক রোহিঙ্গা ও রাখাইন নাগরিক হতাহত হওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে। এসব মাইন বিস্ফোরণের ঘটনায় অনেক রোহিঙ্গা হতাহত হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ বিরতি চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আরসার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে।

মিয়ানমার ভিত্তিক অনলাইন পত্রিকা ইরাবতীর ইংরেজি ভার্সনে ৫ জুন প্রকাশিত খবরে জানা যায়, উত্তর রাখাইনের বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মি ডেক গ্রামে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আরসার বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার বিকেলে অভিযান চালায়। এতে দুই আরসা সদস্য নিহত হয় এবং প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একাধিক সদস্য আহত হয়েছে বলে বিবৃতি দেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিন থুন।

তবে স্থানীয় সূত্র মতে, এই সংঘর্ষের ঘটনায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য নিহত হয় এবং আহত হয়েছে একাধিক সদস্য।
অপরদিকে স্থানীয় বাংলাদেশি গ্রামবাসী জানিয়েছে, তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় কোনারপাড়া এলাকার একটি খাল তুমব্রু খাল হিসেবে পরিচিত। সেখানে এক হাজারের বেশি পরিবারের পাঁচ হাজারের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। তারা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় সেখানে আটকা পড়েন। সেখান থেকে তারা যেন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে এ লক্ষ্যে মিয়ানমার বার বার গুলিবর্ষণ করে আসছিল। পাশাপাশি সীমান্তে কাঁটাতারের বেষ্টনীর পাশঘেঁষে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী একটি সড়ক নির্মাণ করেছে। এটি তুমব্রু থেকে বাইশ ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে গেছে। এই সড়ক দিয়েই এখন প্রতিদিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর যানবাহন চলাচল করে থাকে।

শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক মাঝি দিল মোহাম্মদ জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে জিরো লাইনের কাছাকাছি মিয়ানমারে ব্যাপক গুলিবর্ষণ চলে। প্রায় ঘণ্টাখানেক গুলিবর্ষণের শব্দ পাওয়া গেছে। এতে রোহিঙ্গা শিবিরের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী মাঝেমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভয় দেখানোর জন্য গুলিবর্ষণ করে।

সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে নো-ম্যানস ল্যান্ডে গুলিবর্ষণের খবর পওয়া গেছে। তবে ঘটনাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঘটেছে।’

গত বছর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের প্রতিনিধিদল মিয়ানমার সফরে যান। ওই সময় দেশটি গত ১০ আগস্ট থেকে শূন্যরেখায় ত্রাণ বন্ধের প্রস্তাব দেয় এবং বলে সেখানে অবস্থানরতদের দেশটির মানবিক সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাব মেনে নিলেও শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গারা এতে আপত্তি জানায়। এর আগে বাংলাদেশের সঙ্গে এক বৈঠকে মিয়ানমার নিঃশর্তভাবে শূন্যরেখায় আটকে থাকা এই রোহিঙ্গাদের উত্তর রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগও কার্যকর হয়নি।