ভারতে হাজার হাজার কৃষকের আন্দোলনে কার্যত অবরুদ্ধ রাজধানী দিল্লি

গত প্রায় তিন-চারদিন ধরে ভারতের রাজধানী দিল্লির উত্তরপ্রান্তে এক বিশাল এলাকা কার্যত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আসা হাজার হাজার কৃষকের কব্জায়।

সূত্র : বিবিসি

নিজেদের ট্রাক্টর ও ট্রলিতে বেশ কয়েক মাসের রেশন নিয়ে, খোলা আকাশের নিচে তাঁবু খাটিয়ে শীতের রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই তারা রওনা দিয়েছিলেন দিল্লির পথে – আর এখন রাজধানীর ‘লাইফলাইন’ জাতীয় সড়ক ৪৪ কার্যত তাদেরই দখলে।

দিল্লির বুকে অবস্থানরত এই হাজার হাজার কৃষক কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া আগাম আলোচনার প্রস্তাবও এদিন ফিরিয়ে দিয়েছেন।

সম্প্রতি পার্লামেন্টে পাস হওয়া তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে তারা তুমুল আন্দোলন শুরু করছেন।

পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে আসা এই অসংখ্য কৃষক দিল্লিতে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখায় রাজধানীর একটা বিস্তীর্ণ অংশে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। আরও বহু কৃষক দিল্লিতে ঢোকার চেষ্টায় সীমান্তে অপেক্ষা করছেন।

ট্রাক্টরে তাঁবু খাটিয়ে কৃষকরা শীতের রাত কাটানোর জন্য তৈরি হয়েই এসেছেন
ট্রাক্টরে তাঁবু খাটিয়ে কৃষকরা শীতের রাত কাটানোর জন্য তৈরি হয়েই এসেছেন

এদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আজ তার মাসিক রেডিও ভাষণে নতুন কৃষি আইনের পক্ষে জোরালো সওয়াল করার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

আন্দোলনরত একজন কৃষক সরবজিৎ সিং বিবিসিকে এদিন বলছিলেন, “পাঞ্জাব থেকে লাঠি-জলকামান অনেক কিছু সহ্য করে আমরা এতদূর এসেছি।”

“আর এখন সরকার বলছে আমাদের চুপচাপ গিয়ে বুরারি ময়দানে বসে পড়তে, যেটা কিছুতেই আমরা মানব না। তাহলে আমাদের এই আওয়াজ চাপা পড়ে যাবে।”

“আমরা চাই দিল্লির জল-দুধ-ফল-সব্জির সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দিতে, যাতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ে ও তারা আমাদের কথা শুনতে বাধ্য হয়।”

আন্দোলনরত কৃষকরা ছমাসের খাবারদাবার বা রেশন সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বলেও দাবি করছেন
আন্দোলনরত কৃষকরা ছমাসের খাবারদাবার বা রেশন সঙ্গে নিয়ে এসেছেন বলেও দাবি করছেন

পাটিয়ালা থেকে আসা অমৃক সিং যোগ করেন, “সরকার যতক্ষণ না তিনটি কালা আইন বাতিল করছে এবং কৃষককে সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি দিয়ে একটি চতুর্থ আইন আনছে ততক্ষণ এই আন্দোলন চলবে।”

বস্তুত গতকালই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কৃষকরা যদি রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দিল্লির বুরারি ময়দানে থিতু হন – তাহলে নির্ধারিত ৩রা ডিসেম্বরের আগেও সরকার আলোচনায় বসতে প্রস্তুত।

কিন্তু আজ রবিবার কিষাণ নেতারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন, অন্যদিকে রাজধানীতে উত্তেজনা বাড়ছে।

দিল্লির রোহিণীর বাসিন্দা এক তরুণী যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, “কৃষক আন্দোলনের নামে যেভাবে শহরের চাকরিজীবী বা সাধারণ মানুষ সবাই হেনস্থা হচ্ছেন তা মেনে নেওয়া যায় না।”

দিল্লি সীমান্তে অবস্থানরত কৃষক রমণীরা অবশ্য জানাচ্ছেন, তারা পিছু হঠবেন না এবং দরকারে পাঞ্জাবের গ্রাম থেকে নতুন বাহিনীও দিল্লি অভিমুখে রওনা দেবে।

দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের ঠেকানোর চেষ্টায় পুলিশ বাহিনী
দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের ঠেকানোর চেষ্টায় পুলিশ বাহিনী

ইতিমধ্যে দিল্লি-হরিয়ানার বিভিন্ন গুরদোয়ারা থেকেও আন্দোলনরত কৃষকদের লঙ্গর তৈরি করে বিনি পয়সায় খাওয়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।

এই আন্দোলনে খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদত আছে, এর মধ্যে এই মন্তব্য করে কৃষকদের আরও চটিয়ে দিয়েছেন হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টার।

আর আজ নতুন করে তারা ক্ষেপেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণেও।

মাসের শেষ রবিবার প্রধানমন্ত্রী মোদী যে ‘মন কি বাত’ ভাষণ দিয়ে থাকেন, তাতে তিনি আজ বলেন “পার্লামেন্ট অনেক ভেবেচিন্তেই কৃষি সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন আইন এনেছে।”

“তাতে কৃষকদের অনেক বাধা দূর হয়েছে, অতি অল্প সময়েই তারা এর লাভ পাচ্ছেন” বলেও দাবি করেন তিনি।

কেন্দ্র চায় কৃষকরা দিল্লির বুরারিতে এই ময়দানে থিতু হোন, যা তারা মানতে রাজি নন

মহারাষ্ট্রের মকাই-চাষী জিতেন্দ্র ভোজি কীভাবে নতুন আইনের সুবিধা পাচ্ছেন, তারও দৃষ্টান্ত দেন মোদী।

কিন্তু কৃষকদের আন্দোলন যেহেতু এই আইনগুলোর বিরুদ্ধেই, তারা প্রধানমন্ত্রীর কথায় ক্ষুব্ধ।

দিল্লিতে কৃষক আন্দোলনে যোগ দেওয়া অ্যাক্টিভিস্ট মেধা পাটকরের কথায়, “সরকার তো দাবি করে তাদের সব সিদ্ধান্তই মানুষের পক্ষে।”

“কিন্তু দেশের কিষাণ-মজদুররা সেই চালাকি এখন ধরে ফেলেছে, এবং তারা বুঝে গেছে সরকার শুধু বৃহৎ কর্পোরেটদেরই ধামাধরা।”

দুপক্ষের এই অনড় অবস্থানের মধ্যেই নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলনে রাজধানী দিল্লির একটা বিস্তীর্ণ অংশ অচল হয়ে রয়েছে গত বাহাত্তর ঘন্টারও বেশি সময় ধরে।