রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়বে

বল প্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের যদি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াও সীমান্ত পরিস্থিতি এবং দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক লোক নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে স্থানীয় বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। এছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিককে গলা কেটে ও গুলি করে হত্যা করেছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ৩৫টি ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। ওই ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, মাদক ও মানবপাচারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন সময় সহিংস ঘটনা ঘটছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সহিংসতাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মোহাম্মাদ আলী শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত কয়েকদিন আগের ঘটনাই একমাত্র নয়। ক্যাম্পে যে অপরাধ চক্র গড়ে উঠেছে তাদের নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে মারা গেছে বা ওই ধরনের সহিংস ঘটনায় নিরীহ রোহিঙ্গাদের মারা যাওয়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। এরমধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছেন।’

তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো ক্যাম্পের মতো সংরক্ষিত এলাকায় এরা অস্ত্র পায় কোথায় থেকে? যার সদুত্তর কেউ দিচ্ছে না। ক্যাম্পের মধ্যে মাদক ও মানবপাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে জানিয়ে এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, শত শত কোটি টাকার মাদক ব্যবসা হচ্ছে সেখানে। মানব ও নারী পাচারের মতো জঘন্য কাজও হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে।

মোহাম্মদ আলী শিকদার আরও বলেন, এখন মনে হচ্ছে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ রোহিঙ্গারাই নিয়ে নিয়েছে। সেখানে এখন বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন হিসাবে দেখা দিয়েছে। এই ঘটনাগুলো যা ঘটছে, সেগুলোর আরও বিস্তার ঘটতে পারে। সেখানে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের যদি এখনই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আনা যায়, নিরস্ত্র করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।

একই মত প্রকাশ করে মিয়ানমারে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ডিফেন্স এটাশে মোহাম্মাদ শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মাদক চোরাচালান ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে সেখানে। এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় কিছু চক্র জড়িত, যাদের সবাই চেনে। এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এখনও সংঘবদ্ধ অপরাধ বা অর্গানাইজড ক্রাইম হিসেবে রূপ নেয়নি ঠিক, কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে এরা যদি সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রে পরিণত হয় এবং পরবর্তীতে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমে সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে গোটা অঞ্চলটির পরিস্থিতি অত্যন্ত ভীতিকর হয়ে উঠবে।

মোহাম্মাদ শহীদুল হক আরও বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের আচরণ বিদ্বেষমূলক নয়। এই গ্রুপের সঙ্গে যদি রোহিঙ্গারা মিশে যায়, তাহলে বর্তমান স্থিতিশীল সীমান্ত পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।

মিয়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি সাচিবিক দায়িত্ব পালন করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক ও আইসিটি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. জাহাংগীর আলম। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, গত ৬ জানুয়ারির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিরাপত্তা কার্যক্রম জোরদারের ব্যবস্থা চলমান আছে। সভায় কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে কিছু সময়ের প্রয়োজন হবে।

একই বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করার পাশাপাশি আমাদের ক্যাম্পে স্বাভাবিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করতে হচ্ছে। যখন প্রত্যাবাসন শুরু হবে তখন ক্যাম্পে স্বাভাবিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা জরুরি এবং এর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

সম্প্রতি বিভিন্ন সহিংস ঘটনার কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বৈঠক হয়। যেখানে ক্যাম্পের নিরাপত্তা ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরমধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন, রোহিঙ্গাদের চলাচল সীমিত করার জন্য ক্যাম্পের চারপাশে ফেন্সিং (কাঁটাতারের বেড়া) ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা আরও জোরদার করা।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ক্যাম্প পরিস্থিতি দেখভালের জন্য পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ক্যাম্পগুলোর জন্য মোট ১৪২ কিলোমিটার বেড়া দেওয়ার মধ্যে ইতোমধ্যে ১১১ কিলোমিটার বেড়ার কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগামী ৬ মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এছাড়া ক্যাম্পের লোকজনের গতিবিধি নজরদারিতে রাখার জন্য চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে।