৮ লাখ টাকা না পেয়ে দুই ভাইকে ক্রসফায়ারে দেন ওসি প্রদীপ

`অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফের বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে আদালতে আরো একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রদীপ মোট পাঁচটি হত্যা মামলার আসামি হলেন।

মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী দিদারুল মোস্তফা পরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে তিনজনকে হত্যার অভিযোগ এনে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। তিনজনের মধ্যে দুজন আপন ভাই আর একজন তাদের ভাগনে।‘

‘আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছে কি না এবং নিহতদের ময়নাতদন্ত হয়েছে কি না, তা আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে টেকনাফ থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন’, যোগ করেন আইনজীবী।

মামলার এজাহারে বাদী অভিযোগ করেছেন, গত ৬ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে তাঁর স্বামী সৈয়দ আলম, সৈয়দের ভাই নুরুল আলম এবং তাদের ভাগনে আনসার সদস্য সৈয়দ হোছন ওরফে আবদুল মোনাফকে ওসি প্রদীপ ও এসআই মশিউর রহমানের নেতৃত্বে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

পরে এই তিনজনকে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বাঁচাতে তাদের পরিবারের কাছে ওসি প্রদীপ ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। টাকা না পেয়ে ওই রাতেই তিনজনকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়। তাদের লাশ পড়েছিল তাদের বাড়ির কাছে পাহাড়ের পদদেশে তাদেরই একটি ধানক্ষেতে। সৈয়দ হোছন ওরফে আবদুল মোনাফ নিজেকে আনসার সদস্য পরিচয় দেওয়ার পরও তাকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়।,

মামলার আইনজীবী আরো বলেন, এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ওসি প্রদীপ পরের দিন তিনজনকে মিয়ানমারের নাগরিক উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন।

এর আগে গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর ৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। এতে নয়জনকে আসামি করা হয়। এটিই ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা।

এরপর গত ১৮ আগস্ট চাহিদামতো ঘুষ দেওয়ার পরও এক ব্যক্তিকে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগ এনে প্রদীপ কুমার দাসসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয়। এই মামলাটি করেন টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার গুল চেহের। তিনি অভিযোগ করেছেন, পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার পরও তাঁর ছেলে সাদ্দাম হোসেনকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়। এটি ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় হত্যা মামলা। এই মামলায়ও প্রদীপ কুমার দাশ দুই নম্বর আসামি। মামলার ২৮ আসামির ২৭ জনই পুলিশের সদস্য।

গত ২৬ আগস্ট এক প্রবাসীকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার অভিযোগ এনে তাঁর ভাই কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের আদালত-৩-এ ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে আরেককটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এই মামলায় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দীপক চন্দ্রকে প্রধান আসামি করে বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাসকে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এটি ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে তৃতীয় হত্যা মামলা।

এই মামলায় আসামি মোট ২৩ জন। নিহত প্রবাসী মাহমুদুর রহমানের ভাই নুরুল হোসাইন মামলাটি করেন। শুনানি শেষে ওই ঘটনায় অন্য কোনো হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে কি না, তা আগামী ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জানাতে টেকনাফ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এর পরদিন অর্থাৎ ২৭ আগস্ট টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সানোয়ারা বেগম বাদী হয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিনের আদালতে ১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এই হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। তিনি তাঁর স্বামী আব্দুল জলিলকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় হোয়াইকং পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মসিউর রহমানকে প্রধান আসামি করা হয়। আসামি হিসেবে ওসি প্রদীপ কুমারের নাম রয়েছে দুই নম্বরে। এটি ছিল প্রদীপের বিরুদ্ধে চতুর্থ হত্যা মামলা।

এ ছাড়া গত ১২ আগস্ট মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নে ২০১৭ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী হামিদা আক্তার (৪০) বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলার আসামিদের মধ্যে প্রদীপ ছাড়াও আরো পাঁচজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। ঘটনার সময় প্রদীপ কুমার দাশ মহেশখালী থানার ওসি ছিলেন।

পরের দিন অর্থাৎ ১৩ আগস্ট মহেশখালীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। তবে ওই ঘটনায় তিন বছর আগে পুলিশের দায়ের করা মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের আদেশ দিয়েছেন আদালত।