মানসিক হাসপাতালে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ, ১১ জন গ্রেপ্তার

রাজধানী ঢাকার আদাবরে একটি মানসিক হাসপাতালে একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ ও নিহতের পরিবার। এ ঘটনায় অভিযুক্ত হাসপাতালটির একজন পরিচালকসহ এগারো জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটি ছোট বদ্ধ কামরায় বেশ কয়েকজন মানুষ একজন ব্যক্তিকে টেনে হিচঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে চেপে ধরে মারধর করছে।

পুলিশ বলছে, বলছে, সিসিটিভি ভিডিওতেই পুরো ঘটনাপ্রবাহ স্পষ্ট হয়েছে তাদের কাছে।

নিহত পুলিশ কর্মকর্তার নাম আনিসুল করিম। তিনি একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। তিনি ৩১তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা ছিলেন।

তার সর্বশেষ কর্মস্থল ছিল বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ।

ঢাকায় পুলিশের একজন উপ কমিশনার হারুন-অর-রশিদ আজ এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তারা ভিডিও ফুটেজ দেখে ওই ভিডিওতে থাকা সবাইকে গ্রেপ্তার করেছেন।

মাইন্ড এইড নামের হাসপাতালটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং মানসিক চিকিৎসার হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যেসব লাইসেন্স দরকার হয় তার কোনটিই নেই বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

হাসপাতালটিকে এরই মধ্যে সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ।

মি. রশিদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সিসিটিভি ফুটেজেই দেখা যায় যে, এতোগুলো মানুষ মিলে কিভাবে একজনকে মারধর করছে।

পুলিশ জানায়, ভিডিও ফুটেজে যারা আনিসুল করিমকে টেনে হিঁচড়ে ওই কামরাটিতে নিয়ে যায় তারা কেউই চিকিৎসক ছিলেন না। এদের মধ্যে চার জন ওয়ার্ড বয়, দুজন সমন্বয়কারী, আর কয়েকজন পরিচ্ছন্নকর্মী ছিল।

এদেরকেসহ মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। যাদের মধ্যে হাসপাতালটির একজন পরিচালক ডাঃ নিয়াজ মোর্শেদ।

এদের মধ্যে দশ জনকে আদালতে হাজির করার পর আদালত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে।

উপ কমিশনার মি. রশিদ বলেন, এ ঘটনায় কোন দালাল বা অন্য কেউ জড়িত কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।

এমনকি সরকারি হাসপাতালের কোন চিকিৎসক জড়িত কিনা সে বিষয়েও তদন্ত চলছে বলে জানায় পুলিশ।

যা ঘটেছিল

সোমবার রাজধানী আদাবর এলাকার মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুল করিম। তার পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, হাসপাতালের কর্মীদের মারধরে নিহত হন তিনি।

সোমবার সকালে আনিসুল করিমকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যান তার ভাই রেজাউল করিম।

সেসময় সাথে তার ভগ্নীপতি ও বোনও ছিল বলে জানান তাদের পারিবারিক এক বন্ধু।

ভর্তি করানোর কিছুক্ষণ পরেই তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

পরে তাকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ৭ জন লোক এক ব্যক্তিকে জোর করে টেনে একটি কক্ষে নিয়ে যাচ্ছেন।

সেখানে সবাই মিলে তাকে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে রেখেছে। দুই জন ব্যক্তিকে দেখা যায় যে তারা মি. করিমকে আঘাত করছে।

বাকিরা তাকে চেপে ধরে রাখে। সেসময় তার হাত পেছনের দিকে মুড়িয়ে একটি নীল রঙের কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়।

পরে মি. করিমকে সোজা করে শুইয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। এ পর্যায়ে দুই কর্মীকে দেখা যায় তারা মি. করিমের মুখে পানি ছেটাচ্ছেন। কিন্তু এতেও সাড়া দেননি তিনি।

এর কয়েক মিনিট পরে সাদা রঙের অ্যাপ্রোন পরা এক নারী কক্ষে প্রবেশ করেন এবং তিনি মি. করিমকে মাথায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করেন। এর কিছু পরে তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।

অ্যাপ্রোন পরা আরেক নারী তার রক্তচাপও মেপে দেখেন। প্রথমে আসা নারীকে মি. করিমের বুকে চেপে সিপিআর দিতে দেখা যায়। কিন্তু তাতেও সাড়া দেননি তিনি।

ভিডিওটির সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশের সবগুলো গণমাধ্যমই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ভিডিওটি ওই ঘটনার উল্লেখ করে প্রচার করছে।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানায়, নিজেকে এবং অন্যকে যাতে আঘাত করতে না পারেন তার জন্য ওই কক্ষে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়ার সময় অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।

তবে পুলিশ ভিডিওর বরাত দিয়ে বলছে, এটা স্পষ্টই হত্যাকাণ্ড।

যে কারণে হাসপাতালে নেয়া হয় মি. করিমকে

নিহতের ভাই রেজাউল করিম বিবিসিকে বলেন, পেশাগত দায়িত্ব নিয়ে গত দুই তিনদিন যাবৎ মানসিক চাপে ছিলেন আনিসুল করিম। চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে কারো কাছে কোনকিছু বলতেন না।

তিনি একটু ‘অন্যরকম’ আচরণ করছিলেন, তবে ‘আক্রমণাত্মক’ কোন আচরণ তার মধ্যে ছিলা না, বলেন রেজাউল করিম।

মানসিক চাপের কারণে তাকে বরিশাল থেকে ঢাকাতে নিয়ে এসে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান চিকিৎসক তাকে কয়েক দিন পর্যবেক্ষণের জন্য হাসপাতালে রাখার পরামর্শ দেন।

প্রথমে তাকে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও পরে বেসরকারি মাইন্ড হাসপাতালে নেয়া হয় মি. করিমের ভাষায়, “সরকারি হাসপাতালে পরিবেশ নোংরা থাকায় এবং করোনার শঙ্কা থাকায়”।

গাজীপুরে দাফন

এদিকে পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুল করিমকে তার নিজের জেলা গাজীপুরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

বিবিসি বাংলাকে এ খবর জানিয়েছেন তার বন্ধু মো. কাওসার কিবরিয়া।

তিনি বলেন, ময়না তদন্তের পর গত রাত ১১টার দিকে মরদেহ বুঝে পায় তার পরিবার। পরে মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে জানাজার পর সাড়ে নয়টার দিকে তাকে দাফন করা হয়।