ভারতে বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্যের গোপন রহস্য

কোনো সন্দেহ এখন আর নেই যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি বর্তমানে ভারতের এক নম্বর প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল যারা ২০১৪ সালে থেকে চ্যালেঞ্জ ছাড়াই ভারত শাসন করছে।

সূত্র : বিবিসি

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি পর পর দুটো সাধারণ নির্বাচন জিতেছে। শুধু জেতেইনি, বিপুল সমর্থন নিয়ে জিতেছে। কিছু রাজ্যে বিধান সভা নির্বাচনে হারলেও বিজেপি এখন সর্ব-ভারতীয় একটি দলের চেহারা নিচ্ছে।

অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ক্রমান্বয়ে দুর্বল হচ্ছে এক সময়কার মহা-প্রতাপশালী ও ভারতের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া এই দলটি যেন তাদের রাজনৈতিক শক্তি এবং সম্ভাবনার অনেকটাই নি:শেষ করে ফেলেছে।

মি. মোদীকে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ করার কোনো শক্তি যে তাদের অবশিষ্ট রয়েছে বা তৈরি হচ্ছে তার বিন্দুমাত্র কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

বিজেপির দুই বর্তমান কাণ্ডারি - নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ
বিজেপির দুই বর্তমান কাণ্ডারি – নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুহাস পালশিকার বলছেন, কংগ্রেসের পর ভারতে বিজেপি দ্বিতীয় কোনো দল যারা “প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা“ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছে।

প্রথম ছিল ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস যারা ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারত শাসন করেছে। কিন্তু ১৯৮৪ সালে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের পর বিজেপিই একমাত্র এবং প্রথম দল যারা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।

মি. পালশিকার বলছেন, ইন্দিরা গান্ধীর পর নরেন্দ্র মোদী “একমাত্র রাজনৈতিক নেতা যিনি সত্যিকার অর্থে প্রায় পুরোটা ভারত জুড়ে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পেরেছেন।“

মোদীর ‘সম্মোহন‘

বিজেপির নির্বাচনী সাফল্যের মূলেই রয়েছে মি. মোদীর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব এবং সেই সাথে ধর্মীয় মেরুকরণ ও কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রসার।

আরএসএস ক্যাডারদের শরীর-চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য হিন্দু ঐক্যের ধারণা শক্ত করা
আরএসএস ক্যাডারদের শরীর-চর্চার প্রধান উদ্দেশ্য হিন্দু ঐক্যের ধারণা শক্ত করা

বিজেপির এই রাজনীতির প্রচার এবং প্রসারের পেছনে রয়েছে অক্লান্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর বিশাল এক নেটওয়ার্ক। এসব কর্মীর অনেকেই বিজেপির আদর্শিক পথ-প্রদর্শক কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএস-এর (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সংঘ) বা তাদের “জঙ্গি সহোদর“ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মী।

তহবিলের কোনো সঙ্কট নেই বিজেপির। সাম্প্রতিক বছরগুলোকে দলটি নানা সূত্র থেকে প্রচুর “অস্বচ্ছ“ তহবিল পাচ্ছে। সেইসাথে ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বড় একটি অংশের নি:শর্ত সমর্থন পাচ্ছে তারা।

তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিনয় সিতাপতি বলছেন, বিজেপি এবং সেই সাথে আরএসএস-এর এই রাজনৈতিক সাফল্যের রহস্য জানতে আরো পেছনে যেতে হবে।

অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানির মধ্যে মতভেদ ছিল। তবে তাতে বিজেপি ভেঙ্গে যায়নি।
অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদভানির মধ্যে মতভেদ ছিল। তবে তাতে বিজেপি ভেঙ্গে যায়নি।

হিন্দু ঐক্যের ওপর সদ্য প্রকাশিত ‘যুগলবন্দী: মোদীর আগের বিজেপি‘ শীর্ষক বইতে মি. সিতাপতি লিখেছেন, বিজেপির সাফল্যের কারণ তারা ‘ঐক্যকে’ বিশেষ প্রাধাণ্য দিয়েছে। ৯৫ বছরের কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএসের ক্যাডারদের হিন্দু ধর্মের ইতিহাসের “অদ্ভুত বিকৃত“ ব্যাখ্যা শেখানো হয় যেখানে বলা হয় “মহান জাতি হয়েও হিন্দুরা পরাজিত হয় কারণ তারা এক অন্যের পিঠে ছুরি মারে, এবং তারা ঐক্যবদ্ধ নয়,“ বলছেন অধ্যাপক সিতাপতি যিনি অশোকা ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আইনের শিক্ষক।

ইতিহাসের খণ্ডিত অংশ তুলে ধরে ক্যাডারদের মনে এই ধরণের বিশ্বাস প্রথিত করা হয়। সেই সাথে শেখানো হয় জোটবদ্ধ শরীর-চর্চা। বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে টিম-বিল্ডিং করা হয় অনেকটা সেই ধাঁচে আরএসএসের ক্যাডারদের একসাথে কুচকাওয়াজ করানো হয়, একজনের কাঁধে আরেকজন দাঁড়িয়ে পিরামিড তৈরি করানো হয় এবং নানা ধরণের জোটবদ্ধ খেলাধুলো করানো হয়।

“এগুলো করে প্রধানত ক্যাডারদের মধ্যে ঐক্যের ধারণা এবং গুরুত্ব বোঝানো হয়। আরএসএসের মূলমন্ত্রই হচ্ছে হিন্দু ঐক্য এবং তার প্রতি বিশ্বাস। ঐক্যের এই মন্ত্র ক্যাডার-ভিত্তিক অন্যান্য দলের থেকে অনেকটাই আলাদা”, বিবিসিকে বলেন অধ্যাপক সিতাপতি।

হিন্দু ঐক্য

বিজেপির প্রধান লক্ষ্য ভারতের হিন্দুদের – যারা দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ – ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ানো।

সে কারণে, বিজেপি হিন্দু ধর্মের ভেতর জাতপ্রথার বাস্তবতাকে চাপা দিয়ে রাখতে তৎপর, এবং সেই সাথে “ইসলাম বিদ্বেষকে“ উস্কানি দেওয়া, এবং একই সাথে, অধ্যাপক সিতাপতির মতে, প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রের গুরুত্ব প্রচার করা বিজেপির প্রধান কাজ।

তবে অন্য সব রাজনৈতিক দলের মত বিজেপির ভেতরেও বিভিন্ন নীতি-আদর্শ নিয়ে মতভেদ হয়েছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা দুই নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদাভানির মধ্যে বিভিন্ন সময় যে টক্কর লেগেছে তার প্রমাণ রয়েছে।

যেমন, ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার পরও ঐ রাজ্যের ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদীর রয়ে যাওয়া নিয়ে তখনকার প্রধানমন্ত্রী মি. বাজপেয়ী এবং তার মন্ত্রীসভার কিছু সদস্যের আপত্তি ছিল। কিন্তু তারপরও বিজেপিতে ঐক্য নষ্ট হয়নি।

“এটা অনেকটা অসুখী কোনো পরিবারের মত যার সদস্যরা মতভেদ সত্ত্বেও একসাথে থাকে,“ বলছেন অধ্যাপক সিতাপতি।

যে কোনো রাজনৈতিক দলের ভেতর নানামুখী স্বার্থ কাজ করে, নানা উপদল থাকে এবং এই সব অন্তর্কলহ এবং কোন্দল সত্ত্বেও সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের নেতা, আদর্শ এবং সাংগঠনিক শক্তির কারণে দল ঐক্যবদ্ধ থাকে। ভারতের ক্ষেত্রে আরেকটি উপাদান যোগ হয় – জাতপাত।

মতবিরোধ, নেতাদের ইগো এবং উপদলীয় কোন্দলে ভারতে অনেক রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন সময়ে ভেঙ্গে গেছে। এমনকি কংগ্রেসের মত দল ভেঙ্গে রাজ্যস্তরে সফল আঞ্চলিক দল তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিজেপির ক্ষেত্রে এখনও তেমনটি ঘটেনি।

মি. বাজপেয়ী এবং মি. আদভানির পর এখন দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মি. মোদী এবং অমিত শাহ। আরএসএসের সমর্থনপুষ্ট এই দল এখনও অটুট।

“এটি গোপন কোনো বিষয় নয় যে অনেক বিজেপি নেতা মি. মোদীকে পছন্দ করেন না। অনেক বিজেপি, ভিএইচপি এবং আরএসএসের নেতার আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা আদর্শের প্রতি মি. মোদীর আনুগত্য এবং তার নির্বাচনের জেতার ক্ষমতার প্রশংসা করেন। কিন্তু একইসাথে অনেকেই মনে করেন তিনি নিষ্ঠুর, আত্মপ্রচারলোভী এবং কিছুটা অসামাজিক, “ বলেন অধ্যাপক সিতাপতি।

‘অস্বাভাবিক রাজনৈতিক দল‘

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলন বৈষ্ণব তাই মনে করেন বিজেপি একটি “অস্বাভাবিক রাজনৈতিক দল।“

“এটি আসলে আদর্শভিত্তিক অনেকগুলো হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা। এই নেটওয়ার্ক ভিত্তিক মডেলের কারণে বিজেপি তাদের সাথে সম্পর্কিত তৃণমূল হিন্দু সংগঠনগুলোর কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন ও শক্তি পায়। বিস্তৃত এই নেটওয়ার্কের কারণে দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকরা শেষ পর্যন্ত তাঁবুর নীচেই থেকেই যায়, “ বলছেন অধ্যাপক বৈষ্ণব যিনি ওয়াশিংটনে গবেষণা সংস্থা কার্নেগী এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের একজন সিনিয়র ফেলো।

তবে তার অর্থ এই নয় যে বিজেপির ভেতর কোনো ভিন্নমত অবশিষ্ট নেই।

“তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই বিদ্রোহীরা বুঝতে পারে বেরিয়ে গেলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে। ফলে তারা আবার ফিরে আসে। এর প্রধান কারণ বিজেপির আদর্শিক ভিত্তি এতই শক্ত সেটাই আঠার মতো দলকে বেঁধে রাখছে,“ বলছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাহুল ভার্মা ভারতীয় রাজনীতিতে আদর্শের ভূমিকা নিয়ে একটি বইয়ের অন্যতম লেখক তিনি।

সম্ভাব্য বিপদ

তবে বিজেপির এই ঐক্য যে আজীবন অটুট থাকবে তা অনুমান করা এখনই কঠিন। অন্য দল থেকে বেরিয়ে আসা বা দুর্নাম বা অপরাধের কারণে বহিষ্কৃত রাজনীতিকদের চোখ বন্ধ করে বিজেপিতে নেওয়া হয়। এটাই তাদের নীতি।

রাহুল ভার্মা মনে করেন, এ কারণে এক সময় হয়ত দলের আদর্শিক “বিশুদ্ধতায়“ জং ধরবে। “কতদিন বিজেপি এই স্ববিরোধী নীতিকে সামলাতে পারবে?“ প্রশ্ন মি. ভার্মার।

যতক্ষণ দল নির্বাচনে জিতছে ততক্ষণ যে পারবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সে কারণেই নির্বাচন বিজেপির অস্তিত্বের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

মি. ভর্মা বলছেন, বিজেপির সামাজিক ভিত্তি বিস্তৃত হচ্ছে, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব এখনও প্রধানত উঁচু বর্ণের হিন্দুদের হাতে। তার মতে, এটি আরেকটি সমস্যা যেটাকে ভবিষ্যতে বিজেপিকে বিপদে ফেলতে পারে।

সমালোচকরা বলেন, বিজেপির নির্লজ্জ কুণ্ঠাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতি ভারত রাষ্ট্রের মৌলিক ধারণার চরিত্র বদলে দিচ্ছে যে ধারণার ভিত্তি ছিল সহিষ্ণুতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ।

“ভারত নিয়ে তাদের (বিজেপি, আরএসএস) ধারণারই বিজয় হয়েছে। কারণ তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে গেছে।” বলছেন অধ্যাপক সিতাপতি।