যে কারণে মিয়ানমারের অভ্যুত্থান নিয়ে চিন্তিত নয় দিল্লি

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দার ঝড় উঠলেও চিন্তিত নয় দেশটির প্রতিবেশী ভারত। তাদের চিন্তা মূলত বার্মায় ভারতের চলমান কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প নিয়ে। অভ্যুত্থানের পরও রাখাইনের ভেতর দিয়ে এ প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রয়েছে। এটি কোনওভাবেই ব্যাহত হবে না বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে দিল্লি।

সূত্র: বিবিসি বাংলা।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এ সপ্তাহেই জানিয়েছেন, কালাদান প্রকল্পে এখন শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। মিয়ানমারে যা-ই ঘটুক না কেন, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে তার কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই ভারতের বিশ্বাস।

দিল্লিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে ভারতের যে কোনও অস্বস্তি নেই এটা তারই প্রমাণ।

কালাদান নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি নৌযানকালাদান নদীতে মিয়ানমার নৌবাহিনীর একটি নৌযান

প্রায় সাত বছর আগে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে এখন সেখানে কাজ চলছে ঝড়ের গতিতে। আর দুই দিন আগে আসাম সফরে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বুঝিয়ে দিয়েছেন, মিয়ানমারে ক্ষমতায় কারা আছে, তার সঙ্গে কালাদানের কোনও সম্পর্ক নেই।

বার্মা সফরে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কালাদান আসলে মিয়ানমারের খুব দুর্গম একটা এলাকায় অবস্থিত। তারপরও প্রজেক্টের অনেকটা অংশ, যেমন সিতওয়ে সমুদ্রবন্দর, পালেতোয়া নদীবন্দর চালু হয়ে গেছে।’

এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘নদীর নাব্যতা নিয়ে সমস্যা হওয়ায় প্রজেক্টে আমাদের রাস্তার অংশটা বাড়াতে হয়েছে, আর দেরিটা হয়েছে সেখানেই। কিন্তু এখন আমরা খুবই আত্মবিশ্বাসী যে প্রকল্পের কাজ আমরা দ্রুতই শেষ করে ফেলবো।’

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে এ মাসের গোড়ার দিকে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারত কিন্তু একবারের জন্যও ‘ক্যু’ বা অভ্যুত্থান শব্দটা ব্যবহার করেনি।

Myanmar 03মিয়ানমারে অভ্যুত্থানবিরোধী প্ল্যাকার্ড হাতে এক নারী

দ্য হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর রেজাউল লস্কর বিবিসিকে বলেন, সামরিক জান্তার আমলেও কালাদান প্রকল্পের কাজ যাতে ব্যাহত না হয় ভারত আসলে সেটাই নিশ্চিত করতে চায়।

তার ভাষায়, ‘মনে রাখতে হবে মিয়ানমারে যে সামরিক বাহিনী আছে বা যে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় ছিল, উভয়ের সঙ্গেই ভারতের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। মিয়ানমারে পাওয়ার সেন্টার বা ক্ষমতার কেন্দ্র যারাই হোক, তাদের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়াই ভারতের অভিপ্রায়। সে কারণেই কালাদান প্রজেক্টের কাজ নিয়ে ভারত এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের প্রথম কোয়ার্টারে প্রকল্পের একটা অংশ চালু করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা ছিল সেটা এখনও বহাল আছে।’

কালাদান প্রকল্প মিয়ানমারের যে দুইটি প্রদেশের ভেতর দিয়ে গেছে, সেই শিন আর রাখাইনে বেইজিং-এর প্রভাব মোকাবিলাও ভারতের একটা প্রধান লক্ষ্য। এমনটাই মনে করছেন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘শিন আর রাখাইন, দুই রাজ্যেই কিন্তু চীনের অনেক সংশ্লিষ্টতা আছে। ফলে ভারত মনে করে সেখানে কালাদান নিয়ে তাদের পিছপা হলে চলবে না। তাছাড়া ভারত যে মিয়ানমার আর্মির প্রতি আজকে হঠাৎ ‘সফট’ হয়ে উঠেছে, বিষয়টা কিন্তু মোটেই তেমন নয়। সেই ১৯৯০ থেকেই সম্পর্কের এই রূপান্তরটা ঘটেছে। আর তা ভারতকে অনেক ডিভিডেন্ড বা সুফলও এনে দিয়েছে।’

জয়িতা ভট্টাচার্য বলেন, ‘স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকেও বঙ্গোপসাগরকে ভারত ছাড়তে পারবে না। সেখানেও ভারতের এনগেজমেন্ট বা ইনভলভমেন্ট দরকার, কালাদান সেটাও নিশ্চিত করছে। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের এখন রাষ্ট্রীয় নীতিই হচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে ধরনের সরকারই থাকুক না কেন তার রাজনৈতিক চরিত্র বিচার্য নয়; বরং সম্পর্কটা হবে দুই দেশের সরকারের মধ্যে।’

ফলে অন্যভাবে বললে নেপিডো-তে একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় কি না, সেটা এখন ভারতের কোনও মাথাব্যথা নয়।

দ্য হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর রেজাউল লস্করের মতে, ভারতের বরং অগ্রাধিকার হচ্ছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য চট্টগ্রাম-মংলার পাশাপাশি অন্য একটি বিকল্প বন্দরেও অ্যাকসেস।

তিনি বলেন, ‘কালাদান পুরোপুরি চালু হয়ে গেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য সমুদ্রপথে আরেকটি নতুন রাস্তা খুলে যাবে। কারণ তারা তখন সিতওয়ে বন্দরের অ্যাকসেসটা পেয়ে যাবে।’

রেজাউল লস্কর বলেন, ‘এই মুহূর্তে উত্তর-পূর্ব ভারতের যা সমুদ্রবন্দরের অ্যাকসেস, তার সবটাই বাংলাদেশের মাধ্যমে। সেটা আপনি চট্টগ্রাম বন্দরই বলুন, কিংবা মংলা। ভারতের এই কানেক্টিভিটি অপশনগুলো আরও ডাইভার্সিফাই করার ভাবনা তাই স্বভাবতই আছে। সিতওয়ে বন্দর চালু করে কালাদান প্রকল্পের কাজ শেষ করা গেলে ঠিক সেটাই হবে। বিকল্প একটা সমুদ্রপথ খুলে যাবে। ফলে আপনি বলতে পারেন কালাদান আসলে বাংলাদেশকেও একটা বার্তা দেওয়া যে, ভারতের কিন্তু অন্য অপশনও আছে।’

কালাদান প্রকল্প শেষ হলে তা রাখাইন প্রদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রাস্তা খুলে দেবে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথকে প্রশস্ত করবে, ভারতের পক্ষ থেকে এমন যুক্তিও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ যে চায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ভারত মিয়ানমারের ওপর বেশি করে চাপ প্রয়োগ করুক, সেই প্রত্যাশা মেটার কোনও লক্ষণ কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে না।