রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভিন্ন হাতিয়ার ইউক্রেনের

আগ্রাসী শক্তি রাশিয়াকে বয়কটের উদ্যোগ জোরালো করতে প্রযুক্তি জায়ান্টদের দিকে ঝুঁকছেন ইউক্রেনের ৩১ বছরের ডিজিটাল রূপান্তর বিষয়ক মন্ত্রী মাইখাইলো ফেদোরভ। হ্যাকারদের প্রতি তিনি রুশ লক্ষ্যবস্তুতে সাইবার হামলার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউক্রেনের সুবিধার জন্য ইলন মাস্ককে স্যাটেলাইট স্থানান্তরের অনুরোধ করছেন। আর এর বেশিরভাগই করা হয়েছে স্মার্টফোন থেকে। 

সূত্র : বিবিসি

কিয়েভের একটি গোপন স্থানে নিজের ভূগর্ভস্থ আশ্রয়স্থল থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনের সর্বকনিষ্ঠ এই মন্ত্রী। নিজের আবাসস্থল থেকে বোমার আওয়াজ শুনতে পান তিনি। শুনতে পান সতর্কতামূলক সাইরেনের শব্দও। মাইখাইলো ফেদোরভের বন্ধু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যখন সম্মুখ সমরের জন্য সেনাসমাবেশ করছেন, তখন মিখাইলো ফেদোরভ এবং তার টিম রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

সোশ্যাল মিডিয়া

চলমান যুদ্ধে মাইখাইলো ফেদোরভের পছন্দের অস্ত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে দুনিয়ার বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের অনুরোধ জানাচ্ছেন তিনি। ‘শত্রুর’ বিরুদ্ধে সাইবার হামলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন ‘আইটি আর্মি অব ইউক্রেন‌’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠনের। তার কর্মকাণ্ডকে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।Mykhailo Fedorovমাইখাইলো ফেদোরভ

বয়কট রাশিয়া

ব্যক্তিগত লাইফস্টাইল থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকাণ্ড, সব ক্ষেত্রেই তার অপরিহার্য হাতিয়ার মোবাইল ফোন। যুদ্ধের আগে তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, স্মার্টফোন ব্যবহার করে কিভাবে শতভাগ সরকারি পরিষেবা নাগরিকদের অনলাইনে দেওয়া যায়! বিদ্যমান যুদ্ধাবস্থায় স্বভাবতই সেই প্রকল্প আটকে আছে। এখন সর্বশক্তি দিয়ে ডিজিটাল যুদ্ধ অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। রাশিয়াকে বয়কটের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন।

অ্যাপল, গুগল, ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা, টুইটার, ইউটিউব, মাইক্রোসফট, সনি, ওরাকল; কোনও টেক জায়ান্টকেই সরকারি চিঠি পাঠানো হয়নি। ফেদোরভ বরং তার চিঠিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন, যাতে পুরো দুনিয়া সেটি দেখতে পারে। কোনও কোনও দরকারি অনেক পোস্টে রিপ্লাই দিয়েও ইউক্রেনের ন্যায়সঙ্গত দাবির কথা তুলে ধরছেন তিনি।

তার এই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিটিজম বৃহৎ কোম্পানিগুলোর কর্মকাণ্ডকে কতটা প্রভাবিত করছে সেটি সেটি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠানই তার পোস্টের পরবর্তী দিনগুলোতে রাশিয়ার প্রতি তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে। হয় অ্যাপলের মতো সেখানে পণ্য বিক্রি করা বন্ধ করেছে কিংবা রাশিয়ায় নিজেদের কার্যক্রম স্থগিত করেছে তারা।

ফল মিলছে

শনিবার এক বিবৃতিতে রাশিয়ায় নিজেদের আর্থিক লেনদেন পরিষেবা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে অনলাইনভিত্তিক জনপ্রিয় পেমেন্ট সিস্টেম পেপ্যাল। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী ড্যান শুলম্যান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তার প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলিতভাবে রুশ আগ্রাসনের নিন্দায় শামিল হয়েছে।

পেপ্যালের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসার আগেই টুইটারে বিষয়টি অবহিত করেন ইউক্রেনের মন্ত্রী মাইখাইলো ফেদোরভ।

মার্কিন রকেট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্কের উদ্দেশে একটি টুইট করেছিলেন ইউক্রেনের এই তরুণ রাজনীতিক। ওই টুইটের ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রিপ্লাই দেন ইলন মাস্ক। রুশ আগ্রাসনের ফলে ইন্টারনেট পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ায় ইউক্রেনে স্পেসএক্সের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট টার্মিনাল সরবরাহের ঘোষণা দেন তিনি।

ইন্টারনেট এবং টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হলে স্টারলিংকের পরিষেবাটি ইউক্রেন সরকারের জন্য একটি সম্ভাব্য লাইফলাইন হতে পারে।

টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টেলিগ্রামজুড়ে ফেদোরভের পাঁচ লাখেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে নিজের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন তিনি।

ইমেইলের মাধ্যমে তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম এখন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেনে এখন যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে সে ব্যাপারে আমরা বড় বড় কোম্পানিগুলোর মনোযোগ আকর্ষণের প্রতিটি সুযোগ ব্যবহার করছি। আমরা রাশিয়ানদের কাছে সত্য তুলে ধরার এবং তাদের যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছি।’

আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি স্থানীয় ভাষায় অনলাইনে নানা পোস্ট করতেন তিনি। কিন্তু রুশ আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সংকটের পর থেকে টুইটারে নিয়মিত ইংরেজিতে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কাড়তেই পোস্টের ভাষা হিসেবে এখন ইংরেজিকে বেছে নিয়েছেন তিনি। আর এই জায়গাটাতেই মূলত তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। দুনিয়াজুড়ে মানুষ খুব সহজেই তার পোস্ট অনুধাবন করতে পারছে।

স্মার্ট ও শান্তিপূর্ণ হাতিয়ার

তিনি বলেন, ‘টুইটার একটি দক্ষ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যা আমরা রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মোকাবিলায় ব্যবহার করছি। এটি রাশিয়ান অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য আমাদের স্মার্ট ও শান্তিপূর্ণ হাতিয়ার।’

প্রযুক্তি গবেষক এবং লেখক স্টেফানি হেয়ারের মতে, ফেদোরভ যে সাফল্য পাচ্ছেন তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। তিনি বলেন, ‘সংঘাতে এ ধরনের চর্চা নতুন নয়। যোগাযোগ, প্ররোচনা, প্রচার বা তথ্যযুদ্ধে জড়িত হওয়ার কাজটি সব পক্ষই করে এবং দীর্ঘদিন ধরে এটি করে এসেছে।’

তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো এখন সমীকরণের অংশ। মানুষ তাদের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকায় এখন এই কোম্পানিগুলোকে হিসাব করছে।

ফেদোরভ ক্রিপ্টো কারেন্সি এক্সচেঞ্জগুলোকেও সব রুশ নাগরিকদের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

আইটি আর্মি

দুনিয়াজুড়ে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবী হ্যাকারসহ মন্ত্রণালয়ের ‘আইটি আর্মি অব ইউক্রেন’-এর টেলিগ্রাম গ্রুপে এখন দুই লাখ ৭০ হাজার সদস্য রয়েছে। স্বভাবই বিষয়টি রাশিয়ার জন্য কিছুটা হলেও অস্বস্তি তৈরি করেছে।

মাইখাইলো ফেদোরভ বিবিসিকে বলেন, ‘ট্যাংকের বিরুদ্ধে প্রযুক্তিই সেরা সমাধান।’

তিনি জানান, ইউক্রেনের আইটি আর্মি রাশিয়ান ও বেলারুশিয়ান ব্যবসায়িক কর্পোরেশন, ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় ওয়েব পোর্টালগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে।

ইউক্রেনের এই মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রাশিয়ান পাবলিক সার্ভিসের ওয়েব পোর্টাল, এক্সচেঞ্জ, তাস (রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম)-এর ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করে দিয়েছি। কমার্স্যান্ট, ফন্টাঙ্কা এবং রাশিয়ার অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় মিডিয়া যা রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের জনগণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রশদ যোগায় সেগুলো আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।’

এসবের পাশাপাশি অনলাইনে নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর জন্য তহবিল সংগ্রহ করছে তারা। বিবিসি অবলম্বনে।