সম্পদের লোভে পাবনায় তিন খুন, ইমামের ভয়াবহ স্বীকারোক্তি

পাবনা শহরে তিন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মসজিদের ইমাম তানভীর ইসলাম। 

পাবনার অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল জব্বার, তাঁর স্ত্রী ছুম্মা খাতুন ও দত্তক মেয়ে সানজিদা হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ‘ধর্মসন্তান’ পাবনার ফায়ার সার্ভিস মসজিদের ইমাম তানভীর ইসলামকে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে  ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে তিন খুনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন তানভীর।

তানভীর পুলিশকে জানান, নিহত জব্বার দম্পতির বাবা-মা হওয়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। নিজেদের কোনো সন্তান না হওয়ায় তাঁরা তাঁর এক আত্মীয়র সন্তান রাব্বীকে প্রথমে দত্তক নেন। রাব্বি মাদকে আসক্ত ও বখাটে হওয়ায় তাঁকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে দত্তক নেওয়া হয় সানজিদা নামের এক মেয়েকে। তানভীর এসব তথ্যই জানতেন। তাই তিনি জব্বার দম্পতির সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে সম্পদের লোভে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তানভীরের স্বীকোরোক্তি অনুযায়ী তাঁর কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্র,  লুট করা অর্থ ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া তানভীর নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার হরিপুর গ্রামের মৃত হাতেম আলীর ছেলে।

পাবনা শহরে তিন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া মসজিদের ইমাম তানভীর ইসলামকে আদালতে হাজির করে পুলিশ।

আজ রোববার দুপুরে পাবনা জেলা পুলিশ লাইনস অডিটরিয়ামে এই চাঞ্চল্যকর তিন খুনের বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম এসব তথ্য জানান।

এ ছাড়া ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস। তাঁর লেখা নিচে দেওয়া হলো :

৫ জুন দুপুর আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটের সময় পাবনা থানাধীন দিলালপুর ফায়ার সার্ভিসের পাশের এলাকা থেকে বিভিন্ন লোকজন থানায় খবর দেয় যে, ফায়ার সার্ভিসের পাশে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল জব্বারের ভাড়া বাড়ি থেকে উৎকট পঁচা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সংবাদ পাওয়া মাত্র পাবনা জেলার অফিসার-ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। বাড়ির ভেতরে উৎকট পঁচা গন্ধসহ বাড়ির মেইন দরজা তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়। উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় মেইন দরজার তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করলে গন্ধের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাড়ির ভেতর কক্ষগুলো তালাবদ্ধ থাকায় পশ্চিম পাশের কক্ষের জানালা দিয়ে ভেতরে খাটের ওপর অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল জব্বারের মৃতদেহ এবং পূর্ব পাশের কক্ষের জানালা দিয়ে তাঁর স্ত্রী ছুম্মা বেগম ও মেয়ে সানজিদা ওরফে জয়ার মৃতদেহ খাটের ওপর পঁচা অর্ধগলিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

পাবনা শহরে তিন খুনের ঘটনায় জব্দ হওয়া টাকা ও আলামত।

মুহূর্তেই অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তাসহ একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হওয়ার বিষয়টি পাবনা শহরে বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে এবং সাংবাদিকসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, ডিবি, সিআইডি, পিবিআইয়ের সদস্যরা উপস্থিত হন। সিনিয়র পুলিশ অফিসারসহ পাবনা থানা ও ডিবির একাধিক টিম গঠন করে অভিযান পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। সেইসঙ্গে ঘটনাস্থলের আলামতের যথাযথ সংরক্ষণের নিমিত্তে রাজশাহীতে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ টিমকে তলব করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিআইডি বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তালাবদ্ধ কক্ষগুলোর তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে তাদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নৃশংসভাবে হত্যা করাসহ ঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো অবস্থায় দেখতে পায়।

সিআইডির বিশেষজ্ঞ টিম অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আলামতগুলো পরীক্ষা এবং জব্দতালিকামূলে জব্দ করে। পুলিশের একটি টিম লাশের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যান্য টিম পুলিশ সুপার, পাবনার নিদের্শনা মোতাবেক হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনসহ আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে তৎপরতা শুরু করে। পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত গৌতম কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মো. ইবনে মিজান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) খন্দকার রবিউল আরাফাতসহ থানা পুলিশ ও ডিবি, পাবনার অফিসার ফোর্সের সমন্বয়ে গঠিত একটি চৌকস টিম অতি অল্প সময়ের মধ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও আনুষঙ্গিক তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে হত্যাকাণ্ড সংগঠনকারী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে এবং সন্দেহভাজন জড়িত আসামিকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে ডিবির উক্ত টিম অভিযান শুরু করে। একপর্যায়ে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড সংগঠনকারী আসামি তানভীর হোসেনকে (২৫) নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার হরিপুরের নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। গ্রেপ্তারের পরে তাকে জেলা গোয়েন্দা শাখা, পাবনা অফিসে নিয়ে এসে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে একে একে তিনি এই রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতে থাকেন।

মাতৃত্বের লোভ বনাম অর্থের লোভ

নিঃসন্তান দম্পতির মা-বাবা হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষাই তাদের এই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল জব্বার চাকরিজীবন শেষ করলেও নিজ ঔরসে জন্মগ্রহণ করেনি কোনো সন্তান। বাধ্য হয়ে একদিন বয়সী সানজিদাকে সন্তান হিসেবে লালনপালন করতে থাকে। মৃত্যুকালে সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। সানজিদাকে মেয়ে হিসেবে লালনপালন করলেও বাড়ির পাশে থাকা ফায়ার সার্ভিস মসজিদের ইমামতি করা তানভীর হোসেনের আচার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে তাকেও সন্তানের মতো ভাবতে থাকে মৃত ছুম্মা বেগম। যদিও তাদের পরিচয় ইমামতি করার পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস মোড়েই তানভীর পরিচালিত দোকান থেকে চাল কেনার সূত্র ধরে। প্রায় দেড় বছর আগে হয় এই পরিচয়। দিনে দিনে বাড়তে থাকে সম্পর্কের গভীরতা। একপর্যায়ে সম্পর্কটা রূপ নেয় মা-ছেলের। তানভীর ছুম্মা খাতুনকে মা বলেই ডাকতেন। সেই সূত্রে তানভীরের অবাধে যাওয়া আসা ছিল অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা জব্বারের বাড়িতে। একপর্যায়ে জব্বার নিজেও তানভীরকে ছেলের মতোই বিশ্বাস করেন এবং পরিবারের সব কিছুই তার সঙ্গে শেয়ার করেন। এমনকি ব্যাংক, পোস্ট অফিস থেকে টাকা তোলার সময়ও তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তার পরিবারের জীবনে।

পাবনা শহরে তিন খুনের ঘটনায় পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলন।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও তাঁর স্ত্রী তানভীরকে এতটাই আপন করে নিয়েছিলেন যে রোজার সময় সেহেরি, ইফতারও তাঁকে সঙ্গে নিয়ে  খেতেন। তাঁরা তাঁকে আপন করে নিলেও তানভীর কখনোই তাঁদের আপন মনে করেননি। তিনি মনে মনে তৈরি করেন ভয়ংকর পরিকল্পনা, আঁকতে থাকেন বাড়ির টাকাপয়সা লুট করার ছক আর অপেক্ষা করেন সুযোগের। তাঁর এ পরিকল্পনা মতেই তিনি নিজেকে আইনের চোখ ফাঁকি দিতে গত ২৯ মে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যান। কিন্তু ছুটি শেষ না হলেও ৩১ মে পাবনা আসেন এবং রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রবেশ করেন আবদুল জব্বারের বাড়িতে। কোনো কিছু না বুঝেই আবদুল জব্বার একই বিছানায় নিজের পাশে ঘুমানোর স্থান দেন তাকে। একে একে বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলেও তানভীর পার করেন নির্ঘুম রাত। অপেক্ষা করতে থাকেন সুযোগের। রাত আনুমানিক ২টার সময় একবার বিছানা থেকে উঠে গোটা বাড়ির পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করেন। প্রস্তুত করে রাখেন হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সব ধারালো চাকু ও কাঠের বাটাম। যাতে কোনোভাবে তার উদ্দেশ্যে ব্যর্থ না হয়। আবারও এসে শুয়ে পড়েন আবদুল জব্বারের পাশে।

রাত যখন ঠিক ৪টা  ৫ মিনিট। আবদুল জব্বার বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠতে গেলে পেছন থেকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করেন একই বিছানায় শুয়ে থাকা তানভীর। বয়োবৃদ্ধ আবদুল জব্বার শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য তানভীরের ডান হাতের আঙুলে কামড়ে ধরেন। এতে তাঁর একটি আঙুল কেটে যায়। এতেও ক্ষান্ত হননি তানভীর। গামছা দিয়ে আরো শক্ত করে গলা পেঁচিয়ে ধরেন। একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পড়ে যান আবদুল জব্বার। সঙ্গে সঙ্গে তানভীর জব্বারের বুকের ওপর চালিয়ে দেন ধারালো চাকু। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে গোটা ঘরে।

আবদুল জব্বারের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে পাশের রুমে যান তানভীর। সেখানে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন ছুম্মা বেগম ও শিশু মেয়ে সানজিদা। মশারির দড়ি কেটে দিয়েই তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন  তানভীর। প্রথমেই ছুম্মা বেগমকে ধারালো চাকু দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকেন। ঘুমন্ত ছুম্মা বেগমের গলার রক্তের গড়গড় শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সানজিদার। সে উঠে চিৎকার দিতে গেলে তাকেও ধারালো চাকু দিয়ে আঘাত করেন তানভীর। চাকুর আঘাতে সে বিছানায় পড়ে গেলে তানভীর হাতে তুলে নেয় কাঠের বাটাম। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত নৃশংসভাবে উভয়ের মাথায় আঘাত করেন। একপর্যায়ে দুজনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। চাবি দিয়ে একে একে খুলেন বাড়ির সব আলমারি ও ওয়ারড্রোব। লুট করে নেন দুই লাখ টাকা, এক লাখ ভারতীয় রুপি ও সোনার গয়না।

লুটপাট শেষে তানভীর পুনরায় যান আবদুল জব্বারের ঘরে। তখনো চলছিল তাঁর শ্বাস প্রশ্বাস। সে টুকুও অবশিষ্ট রাখেননি তানভীর। ফিরে যান পাশের রুমে। হাতে তুলে নেন কাঠের বাটাম। এসে উপর্যুপরি আঘাত করেন জব্বারের মাথায়। এবার সত্যিকারভাবে নিশ্চিত হন জব্বারের মৃত্যু। তারপর বাথরুমে গিয়ে রক্ত মাখা কাপড়-চোপড় ধুয়ে গোসল করে বাড়ির সব গেটে তালা দিয়ে সন্তর্পণে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েন।

এরই মধ্যেই মসজিদের মাইকে ভেসে ওঠে ফজরের আজানের  ধ্বনি। যে ইমাম মুসল্লিদের নামাজে ইমামতি করতেন তিনি আজানের ধ্বনি শুনেও মসজিদে নামাজ না পড়ে রাতভর চালানো হত্যার দায় থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য রওনা দেন নিজ বাড়ির উদ্দেশে। পথে নাটোরে কোনো এক ডাক্তারের দোকান থেকে চিকিৎসা করান তাঁর কেটে যাওয়া আঙুলের। চিরতরে শেষ হয়ে যায় নিঃসন্তান দম্পত্তির বাবা-মা হওয়ার ইচ্ছে।

জেলা পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, নগদ টাকা ও সম্পত্তির লোভে তানভীর জব্বারকে সপরিবারে হত্যা করেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যাদের মধ্যে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামীমা আক্তার মিলি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইবনে মিজান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল আরাফাত লেলিন, পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাছিম আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন।