জালিয়াতি মামলায় আটক ডা. সাবরীনা আরিফ

তিনি একজন চিকিৎসক। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি টকশো কিংবা স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনার নিয়মিত মুখ। দিতেন সুস্থ থাকার নানা ফর্মুলা। তাঁর নাম ডা. সাবরীনা আরিফ। তিনি চিকিৎসক মহলে বেশ প্রভাবশালীও বটে।

ডা. সাবরীনা আরিফের প্রভাব

বেশ কয়েকটি সূত্রে জানা যায়, চিকিৎসাবিষয়ক মহলে ডা. সাবরীনা অনেক প্রভাব আছে। চিকিৎসকদের একটি প্রভাবশালী সংগঠনের এক প্রভাবশালী নেতার জুনিয়র বান্ধবী তিনি। সেই সুবাধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়েও ছিল তাঁর প্রভাবের বিস্তৃত ডালপালা। আর এতসব কিছুকে কাজে লাগিয়ে এই করোনা মহামারির সময়ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন তিনি।

সাবরীনার ক্ষমতার ব্যবহার 

সাবরীনার ক্ষমতাবলে জোবেদা খাতুন স্বাস্থ্যসেবা (জেকেজি) প্রজেক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাগিয়ে নেয় করোনার স্যাম্পল কালেকশনের সুযোগ। প্রথমে রাজধানীর তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি নেন ডা. সাবরীনা। পরে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা এবং অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিল তাঁর এই প্রতিষ্ঠান। জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে জেকেজি করোনার নমুনা সংগ্রহ করলেও শুরু করে প্রতারণা। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে ইচ্ছেমতো রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ উঠে সাবরীনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। জেকেজির কয়েকজন কর্মী গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ও সাংবাদিকদের বলেন, তারা রোগীদের জ্বর থাকলে তাদের করোনা পজিটিভ আর জ্বর না থাকলে নেগেটিভ রিপোর্ট দিত।

সাবরীনার প্রতিষ্ঠানে পুলিশের অভিযান

এরই পরিপেক্ষিতে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট প্রদানের অভিযোগে গত ২৩ জুন জেকেজিতে অভিযান পরিচালনা করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। অভিযানের দিন প্রতারণার মূল হোতা ও জেকেজির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন ডা. সাবরিনা ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবরীনাকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা

পুলিশের অভিযানের পর থেকে জেকেজির প্রতারণা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ প্রতারণায় আরিফের অন্যতম সহযোগী তাঁর স্ত্রী ও জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরীনা। কেন ডা. সাবরীনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধরছে না তা নিয়েও শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই ডা. সাবরীনার ছবি দিয়ে শুরু হয় ট্রল। তাঁর নানা ধরনের আবেদনময়ী ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে। অবশেষে আজ রোববার তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ। ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে।

এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ফন্দি এঁটেছিলেন সাবরীনা

আজ রোববার গ্রেপ্তার করা হলেও এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন সাবরীনা আরিফ। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে প্রতারণার এই ঘটনার দায় এড়াতে তিনি নানা ফন্দি এঁটেছিলেন। চিকিৎসকদের সংগঠনের প্রভাবশালী ওই নেতার বান্ধবী হওয়ায় অনেকেই মনে করেছিলেন ডা. সাবরীনা দায় থেকে রেহাই পেয়ে যাবেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর।

করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান

করোনার এই মহামারির সময়ে যখন অনেক মানুষ মানবিক হয়ে উঠেছেন ঠিক তখন জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা করেছেন সাবরীনার প্রতিষ্ঠান জেকেজি। নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই দিয়েছে ভুয়া রিপোর্ট। বাংলাদেশ ছাড়া করোনায় নুয়ে পড়া বিশ্বে এসব ঘটনাকে ভয়ংকর গল্প বলে খবর প্রকাশ করেছে। এসব গল্পের মতোই জীবন ডা. সাবরীনা ও আরিফ চৌধুরীর। তিনি আরিফ চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী। আরিফের দুই স্ত্রী থাকেন রাশিয়া ও লন্ডনে। আরেক স্ত্রীর সঙ্গে আরিফের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী উচ্চমহলে আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন বলে জানা যাচ্ছে।

জিজ্ঞাসাবাদের পর সাবরীনাকে গ্রেপ্তার

করোনা রিপোর্ট নিয়ে প্রতারণার ওই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আজ রোববার দুপুরে তাঁকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগীয় উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তেজগাঁও বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়াসহ নানা বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানোর কথা জানান হারুন অর রশিদ।

তেজগাঁও থানা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জেকেজি থেকে ২৭ হাজার রোগীকে করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটি ল্যাপটপের মাধ্যমে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে রোগীদের প্রদান করে। জব্দ করা ল্যাপটপে এর প্রমাণও পেয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

জেকেজির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেওয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করতেন। যাদের নমুনা সংগ্রহ করতেন তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে প্রতি রিপোর্টের জন্য পাঁচ হাজার টাকা নেওয়া হতো। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নিতেন ১০০ ডলার। তেজগাঁও থানা পুলিশ এই তথ্য জানিয়েছিল।

গত ২৩ জুন তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (অপারেশন) হাসানাত খন্দকার এনটিভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘করোনা পরীক্ষার কথা বলে ভুক্তভোগী রোগীর সঙ্গে প্রতারণার দায়ে ওভাল গ্রুপের মালিক আরিফ চৌধুরীসহ মোট ছয়জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। সাবরীনা ছিলেন ওভাল গ্রুপের চেয়ারম্যান। জোবেদা খাতুন স্বাস্থ্যসেবা প্রজেক্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাড়ি বাড়ি গিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহ করত। এই নমুনা সংগ্রহের পর তা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত না। পরীক্ষা না করেই নিজেদের কম্পিউটার দিয়ে করোনার রিপোর্ট বানাত। এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছিল। পরে আমরা তাদের গ্রেপ্তার করি। তারা করোনা রোগীদের সঙ্গে দুই মাস ধরে এই প্রতারণা করছে।’